দেশি মুরগির ঝিমানো রোগ ও চুনা পায়খানা রোগের চিকিৎসা ২০২৪

 
আপনি যদি একজন সফল খামারি হন তাহলে আপনাকে অবশ্যই মুরগি পালনের সঠিক নিয়ম ও ওষুধ সম্পর্কে ধারণা রাখতে হবে। বাণিজ্যিকভাবে দেশি মুরগি পালন করা করতে চাইলে দেশি মুরগির বিভিন্ন রোগ, দেশি মুরগির ঝিমানো রোগের ওষুধ, দেশি মুরগির ঝিমানো রোগের চিকিৎসা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।

অন্যান্য মুরগির চাইতে তুলনামূলকভাবে দেশি মুরগির রোগ কম হয়। কিন্তু রোগ কম হয় বলে দেশি মুরগির পালনে কখনো পিছ পা যাবে না। অবশ্যই রোগ প্রতিরোধের জন্য পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। দেশি মুরগির ঝিমানো রোগ ও চুনা পয়খানা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব। 

সূচিপত্র 

ভূমিকা 

প্রাচীনকাল থেকে দেশি মুরগি বন জঙ্গলে প্রাকৃতিক ভাবে ঘুরে বেড়াতো। কিন্তু এক সময় কোন একজন ব্যক্তি এই মুরগিকে পোষ মানিয়ে বাড়িতে পালন করতে শুরু করে। ধীরে ধীরে এ মুরগির চাহিদা বাড়ায় বাণিজ্যিক ভাবে দেশি মুরগী পালন করা শুরু হয়। আমাদের দেশে অনেক খামারি আছেন যারা দেশি মুরগি পালন করর প্রতি মাসে লক্ষাধিক টাকা আয় করে। 

দেশি মুরগির মাংস আমিষের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি খেতে অত্যন্ত সুস্বাদু। দেশি মুরগির অত্যন্ত ভিটামিন প্রোটিন যুক্ত হওয়ার বাজারে এই মুরগির চাহিদা রয়েছে। অন্যান্য মুরগির চাইতে তুলনামূলকভাবে প্রতি কেজি মুরগির দাম ৩০০-৩৫০ টাকার বেশ হয়। আপনি যদি একজন দেশি মুরগির সফল খামারি হয়ে থাকেন সেক্ষেত্রে আপনাকে দেশি মুরগি পালনর সকল রোগ সম্পর্কে এবং রোগের চিকিৎসা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে হবে। 

মুরগির ঝিমানো রোগের নাম

দেশি মুরগি অথবা যেকোন মুরগি বিভিন্ন রোগের কারণে ঝিমাতে পারে। মুরগির ঝিমানো কোন রোগ নয় এটি রোগের একটি লক্ষণ। মুরগির ঝিমানোর সময় মাথা নিচু করে দুই চোখ বন্ধ করে থাকে। এমন সময় মুরগির পাখাগুলো এলোমেলো ও হালকা উসকো খুসকো অবস্থায় থাকে। দেখলে মনে হয় মুরগি দাড়িয়ে ঘুমাচ্ছে এরকম সমস্যাকে মুরগির ঝিমানো রোগ বলা হয়। বিভিন্ন রোগের কারণে মুরগির ঝিমাতে পারে যেমন -
  • ভাইরাস ও ইনফেকশন 
  • প্লেগ, ইনফিক্সাস লারিংগোট্রাকিয়াইটিস
  • বিভিন্ন কৃমি জনিত সমস্যা 
  • ইভিয়ান গাউট রোগ
  • আমাশয়, কলেরা 
  • টাইফয়েড, এসপার জেলোসিস
  • মাইক্রোপ্লাজমোসিস
  • মারেক্স ডিজিজ, বসন্ত 
  • গামবোরো, রানীক্ষেত 
মুরগির উল্লেখিত এ রোগগুলোর কারণে মুরগি ঝিমায়। মুরগি ঝিমানোর পর চিকিৎসা করলে সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম। চিকিৎসকের মতে মুরগির যেকোনো রোগ হওয়ার পূর্বে ওই রোগের চিকিৎসা করা প্রয়োজন। কেননা রোগ দেখা দেওয়ার পর রোগের চিকিৎসা করলে মুরগি সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। 

দেশি মুরগির ঝিমানো রোগের ওষুধ 

অনেকে দেশি মুরগির খামার করে পালন করেন আবার অনেকেই দেশি মুরগি বাড়িতে পালন করেন ডিম ও মাংসের চাহিদা পূরণের জন্য। যারা খামারি আছেন তারা অবশ্যই দেশি মুরগী পালনের জন্য খামারে মুরগি প্রবেশ করানোর পর এক থেকে তিন সপ্তাহের মধ্যেই মুরগির সকল ভ্যাকসিন দেবেন। কেননা দীর্ঘদিন সময় ধরে দেশি মুরগী পালন করতে হবে। 

যারা বাড়িতে মুরগি পালন করেন যদি বেশি সংখ্যক মুরগি থাকে সেক্ষেত্রে ভ্যাকসিন দিতে পারেন। ভ্যাকসিন ড্রপার, ইনজেকশন এর মাধ্যমে মুরগিকে খুব সহজেই দেওয়া যায়। মুরগি ঝিমানো রোগের ক্ষেত্রে যে ওষুধগুলো খাওয়াতে হবে তা হলো -
  • Oxyvet bolus
  • Reena machine
এই দুইটি ওষুধ মুরগির জন্য পরিমাণ মতো খাবার পানিতে মিশিয়ে তিন দিন খাওয়াতে হবে। আশা করি সকল মুরগি সুস্থ হবে। এছাড়া বাচ্চা মুরগির যদি ঝিমায় সেক্ষেত্রে এমোক্সিলিন অথবা মক্সোসিলিন গ্রুপের যেকোনো এন্টিবায়োটিক পরিমাণ মতো মুরগীকে খাওয়াতে হবে। আশা করি দেশি মুরগির ঝিমানো রোগের ওষুধ সম্পর্কে সঠিক ধারণা পেয়েছেন। 

দেশি মুরগির ঝিমানো রোগের প্রাকৃতিক চিকিৎসা 

দেশি মুরগী ভাইরাস জনিত সমস্যার কারণে ঝিমায়। দেশি মুরগি ঝিমানোর সময় যদি আপনি প্রাকৃতিক চিকিৎসা অবলম্বন করেন সেক্ষেত্রে ফলাফল নাও হতে পারে। কিন্তু মুরগির অবস্থা ভালো হলে প্রাকৃতিক কিছু উপায় অবলম্বন করলে মুরগি ঝিমানো সমস্যা হবে না। দেশি মুরগির ঝিমানো রোগের প্রাকৃতিক চিকিৎসায় যে নিয়মগুলো ব্যবহার করা হয় তাহলো : 
  • কেরোসিন 
  • কাঁচা হলুদ 
  • আদাজ্বল
  • লবঙ্গ 
  • নিম পাতার রস 
  • তুলসী পাতার রস 
উপরে উল্লেখিত নিয়মগুলো দেশি মুরগি ঝিমানো রোগের প্রাকৃতিক চিকিৎসা হিসেবে কাজ করে। আশা করি উপায়গুলো অবলম্বন করে খব সহজেই মুরগির ঝিমানো রোগের সমস্যা দূর করতে পারবেন। 

দেশি মুরগির ঝিমানো ও চুনা পায়খানা রোগের চিকিৎসা 

মুরগির ঝিমানো ও চুনা পায়খানা হওয়া রানীক্ষেতের লক্ষণ। রানীক্ষেত হওয়ার পূর্বে মুরগির চুনা পায়খানা হতে পারে মুরগি ঝিমাতে পারে। তাছাড়া ঠান্ডা লাগলে ও গামবোরো রোগ হলে মুরগী ঝিমায় ও চুনা পায়খানা করে। মুরগির ঘরে যদি অতিরিক্ত লিটার জমা হয়ে থাকে সেক্ষেত্রে মুরগির এই রোগগুলো হতে পারে মুরগির ঝিমানো রোগ ও চুনা পায়খানা করতে পারে। 

রোগে আক্রান্ত হওয়ার পর মুরগির ডিম পাড়া বন্ধ হয়ে যায়। এই সমস্যাগুলো দেখা দিলে অবশ্যই সুস্থ ও অসুস্থ মুরগীগুলো আলাদা করে নিবেন। মুরগির আবাসস্থল জীবাণু নাশক দিয়ে পরিষ্কার করে ধুয়ে নিবেন। প্রতি ১০০ পিস মুরগির জন্য ৩ গ্রাম lixen পাউডার চার লিটার জলে মিশিয়ে মুরগিকে খাওয়াবেন। আশা করা যায় মুরগী সুস্থ হবে। 

বড় মুরগির ঝিমানো রোগের ওষুধ 

বড় মুরগি ঝিমানোর ক্ষেত্রে এক এক রোগের ক্ষেত্রে এক এক রোগের ওষুধ প্রয়োগ করতে হবে। মুরগির রোগ অনুযায়ী রোগ বুঝে ওষুধ সেবন করান। ঠান্ডা জনিত সমস্যা মুরগী ঝিমানো মাইক্রোনেট এক লিটার পানিতে এক গ্রাম ওষুধ মিশিয়ে মুরগিকে খাওয়াবেন। এছাড়া napa extra গুড়ো করে নাপা এক্সট্রা সিরাপ মুরগির পানির সাথে খাওয়াতে পারেন। এতে মুরগির ঝিমানো রোগ থেকে সেরে উঠবে। 

মুরগির চুনা পায়খানার ওষুধ 

মুরগির চুনা পায়খানা হলে সাধারণত দুই / একদিনের মধ্যে সেরে যায়। যদি অতিরিক্ত মুরগির চুনা পায়খানা হয় সেক্ষেত্রে প্রতি ২০ পিচ মুরগির জন্য একটি রেনামাইসিন ট্যাবলেট গুড়ো করে খাবারের সাথে মুরগিকে খাওয়ান আশা করি আপনার মুরগি সুস্থ হয়ে যাবে। যদি খামারে অধিক পরিমান মুরগী আক্রান্ত হয় সেক্ষেত্রে ভেটেনারি চিকিৎসাকের পরামর্শ নিতে পারবেন। 

মুরগির বাচ্চার ঝিমানো রোগের ওষুধ  

মুরগির ফাউল টাইফয়েড একটি ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রামক রোগ। মুরগি এ রোগে আক্রান্ত হলে খামারির মারাত্মক লোকসান হয়। খামারিরা চিকিৎসার জন্য অনেক টাকা খরচ করর ফেলেন। তাই মুরগির ফাউল টাইফয়েড রোগের লক্ষণ ও চিকিৎসা সম্পর্কে জেনে রাখা উচিত। 

দেশি মুরগির বাচ্চা সুস্থ রাখার জন্য দেশি মুরগির বাচ্চাকে অবশ্যই প্রথমে ভ্যাকসিন করা প্রয়োজন। দেশি মুরগির বাচ্চা উঠানোর পরে প্রথম তিনদিন যে ওষুধ সেবন করাতে হবে :
  • পুলস্যান প্লাস
  • ইমিউনো প্লাস
  • রিভিটা প্লাস
চতুর্থ দিন যে ওষুধগুলো খাওয়াবেন তাহলো
  • রানীক্ষেত ভ্যাকসিন
  • ইমিউনো প্লাস
পঞ্চম দিন থেকে সপ্তম দিন 
  • রিভিটা প্লাস 
  • চিক নিউরোভিট
এরপর থেকে বিভিন্ন ভিটামিন, লিভার টনিক, জিংক, ক্যালসিয়াম আরো অন্যান্য ওষুধ খাওয়াতে হবে। 

দেশি মুরগির ওষুধের তালিকা - রোগ ও চিকিৎসা পদ্ধতি 

আমাদের দেশে গ্রামঞ্চলে প্রায় প্রতিটি পরিবার দেশি মুরগী পালন করে থাকে। সাধারণত দেশি মুরগী সম্পূর্ণ খোলা পদ্ধতিতে পালন করা হয়। এদের মাংস ও ডিমের চাহিদা বিদেশি মুরগির তুলনায় বেশি এবং দামও দ্বিগুণ। প্রাকৃতিকভাবে এরা ভালো রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন হলেও কিছু কমন রোগ দেশি মুরগীতে দেখা যায়। 
দেশি মুরগির ওষুধের তালিকা 

বয়স দিন ওষুধের নাম
প্রথম দিন লাইসোভিট বা গলুকোজ
২-৪ দিন টানা এমক্সাসিলিন
৩-৫ দিনের ভিতর আইবি+এনডি লাইভ ভ্যাক্সিন
১০-১২ দিনের ভিতর গামবোরো লাইভ ভ্যাক্সিন
১২-১৪ দিন লিভারটনিক ও ভিটামিন
১৮-২২ দিনের ভিতর গামবোরো লাইভ ভ্যাক্সিন
২৪-২৬ দিনের মধ্যে এনডি লাইভ ভ্যাক্সিন
২৪-২৬ দিন এম্প্রোলিয়াম + সিপ্রো
৩০ তম দিন ফাউলপক্স ভ্যাক্সিন
৩৫ তম দিন কৃমিনাশক ওষুধ
৪৫-৪৮ দিনের ভিতর রানীক্ষেত লাইভ ভ্যাক্সিন
৫০ থেকে নিয়মিত
প্রোবায়োটিক+ভিটামিন


মুরগির খাবারের অনীহা, সাদা পায়খানা হলে চিকিৎসা

মুরগির বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হলে খাবার খায়না। আবার ভয় পাওয়া কিংবা স্থানান্তরজনিত কারণে প্রতি অনীহা হতে পারে৷ খাবার হজম না হলে খাবারে আগ্রহ থাকে না। 
  • খামারে কোন মুরগির রোগব্যাধি দেখা দিলে তাৎক্ষণিকভাবে সেগুলোকে আলাদা করে রাখতে হবে। প্রকৃত রোগ শনাক্ত করে রোগ নিয়ন্ত্রণ ও নিমূলের জন্য সু - চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে।
  • মৃত মুরগিকে যেখানে - সেখানে না ফেলে মাটির নিচে পুঁতে ফেলতে হিবে।
  • খামারে দর্শনার্থী ও বাইরের লোকজন যাতায়াত বন্ধ করতে হবে। 
  • খামারের প্রতিদিনের কাজের রেকর্ড রাখতে হবে। খাদ্য প্রদান, তাপমাত্রা, ভ্যানসিনেশন ও রোগের প্রার্দুভবের রেকর্ডসহ কখন কোন টিনা প্রদান করতে হবে। 
  • প্রতিদিন মুরগির শিড আলগা ময়লা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করলে রোগ জীবাণু সহজে প্রবেশ করতে পারবে না। 

লেখকের মন্তব্য 

দেশি মুরগির ঝিমানো রোগের ও চুনা পায়খানার চিকিৎসা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে আজকের এই আর্টিকেলে। আমাদের আলোচনা ছাড়া কোনো প্রশ্ন কিংবা মতামত থাকলে আমাদের কমেন্ট করে জানাতে পারেন। আমরা আপনাদের প্রশ্নের সঠিক উত্তর দেওয়া চেষ্টা করব। 

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url