আধুনিক পদ্ধতিতে করলা চাষের ১০ টি নিয়ম
এক নজরে আধুনিক পদ্ধতিতে করলা চাষ
উন্নত জাত: বারি করলা-১, টিয়া, তাজ ৮৮
পুষ্টিগুণ : প্রতি ১০০ গ্রাম করলার জন্য ৮৩.২ গ্রাম জলীয় অংশ, ১.৪ গ্রাম খনিজ পদার্থ, ১.৭ গ্রাম আশঁ, ৬০ কিলোমিটারি, ২.১ গ্রাম আমিষ, ১.০ গ্রাম চর্বি, ১০.৬ গ্রাম শর্করা, ২৩ মিগ্রা ক্যালসিয়াম, ২.০ মিগ্রা লৌহ, ১২৬ মাইক্রো লৌহ, ১২৬ গ্রাম ক্যারোটিন এবং ৯৬ মিগ্রা ভিটামিন সি আর্দশমান।
বপনের সময় : ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চ ( ফাল্গুন - চৈত্র)
চাষপদ্ধতি : বীজ পলিথিনেও বোনা যায় আবার সরাসরি বেডে/ মাদায় বোন যায়। পলিব্যাগ বা মাদায় কমপক্ষে ২টি করে ২টি করে বীজ বপণ করতে হবে। বীজ বপনের আগে ২৪ ঘন্টা ভিজিয়ে রাখতে তাড়াতাড়ি অংকুরিত হয়।
আরো পড়ুন : সিজারের পর মাত্র ১.৫ মাসে সেরে ওঠার জন্য করণীয় সমূহ
জমি তৈরি ও চারা রোপন পদ্ধতি : বেডের প্রশ্বস্ততা সোয়া ৩ ফুট ও দু বেডের মাঝে ২ ফুট নালা থাকবে। ১৫-২০ দিনের চারা রোপন করা যায়। উচ্ছের জন্য সারিতে সোয়া ৩ ফুট ও করলার জন্য ৫ ফুট দূরত্বে মাদা তৈরি করতে হবে।
আরো পড়ুন : ৭ দিনে ওজন বৃদ্ধির ১০ টি সবথেকে কর্যকারী পদক্ষেপ
বীজের পরিমাণ : জাত ভেদে শতক প্রতি ২৪- ২৮ গ্রাম।
২০ কেজি গোবর, অর্ধেক টিএসপি ও ২০০ গ্রাম পটাশ, সমুদয় জিপসাম, দস্তা, বোরণ জমি তৈরির সময় মাটিতে প্রয়োগ করতে হবে। অবশষ্ট গোবর (মাদা প্রতি ৫ কেজি), টিএসপি (মাদা প্রতি ৩০ গ্রাম) ২০০ গ্রাম পটাশ ( মাদা প্রতি ২০ গ্রাম) সমুদয় ম্যাগনেসিয়াম (মাদা প্রতি ট গ্রাম) চারা রোপণের ৭-১০ দিন পূর্বে প্রয়োগ করতে হবে। চারা রোপণের ১০ -১৫ দিন পর ১ম বার ২০০ গ্রাম ইউরিয়া এবং ২০০ গ্রাম পটাশ (মাদা প্রতি ১৫ গ্রাম) ৩০- ৩৫ দিন পর ২য় বার, ৫০-৫৫ দিন পর ৩য় বার ২০০ গ্রাম করে ইউরিয়া (মাদা প্রতি ১৫ গ্রাম) প্রয়োগ করতে হবে। চারা রোপণের ৭০-৭৫ দিন পর ১০০ গ্রাম ইউরিয়া প্রয়োগ করতে হবে। মাদায় চারা রোপণের পূ্বে সার দেয়ার পর পানি দিয়ে মাদার মাটি ভালভাবে ভিজিয়ে দিতে হবে। অতঃপর মাটিতে জো এলে ৭-১০ দিন পর চারা রোপন করতে হবে।
সেচ: প্রয়োজন হলে সেচ প্রদান করতে হবে। প্রাথমিক অবস্থায় পানির অভাব বৃদ্ধি ব্যবহুত হয়। ফুল আসার সময় পানির অভাব হলে ফুল ঝরে যায়। সেচের পর মাটির চটা ভেঙে দিতে হবে। জুন - জুলাই মাসে বৃষ্টি শুরু হলে সেচের প্রয়োজন থাকে না। তবে এ সময় পানি নিস্কাশন ব্যবস্থা করতে হবে।
আগাছা : জমি নিয়মিত জমি পর্যবেক্ষণ করুন। সেচ ও সার দেবার পর জো আসা মাত্র নিড়িয়ে আগাছা বাছাই। গাছ খুব ঘন থাকলে পাতলা করে দুতে হবে। নিড়ানি দিয়ে জমির আগাছা পরিষ্কার করে দিতে হবে।
আবহাওয়া ও দুর্যোগ : অতি বৃষ্টির কারণে জমিতে পানি বেশি জমে গেলে নালা তৈরি করে তাড়াতাড়ি পানি সরানোর ব্যবস্থা নিতে হবে।
উপরে আধুনিক পদ্ধতিতে করলা চাষের সকল নিয়ম নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। এখন আমরা করলা চাষে পোকামাকড় দমন পদ্ধতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।
করলা চাষে পোকামাকড় :
আধুনিক পদ্ধতিতে করাল চাষের সময় করলায় বিভিন্ন ধরনের পোকামাকড় হয়ে থাকে। সঠিকবাভে তা নিরমল না করলে ফসলের ক্ষতি হবে। আমাদের চাহিদা অনুযায়ী ফলাফল পাব না। তাই করলাতে পোকামাকড় হলে সঠিক পরিচর্য করতে হবে। নিচে করলাতে পোকামাকড় হলে করণীয় সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে -
- করলার কাঁঠালে পোকা- সাইপারমেথরিন জাতীয় বালাইনাশক কট বা ম্যাজিক ১০ মিলি লিটার হারে পানিতে মিশিয়ে সকালের পরে সাজের দিকে স্প্রে করুন।স্প্রের পুর্বে খাবারযোগ্য লতা ও ফল পেড়ে নিন।
- জাব পোকা - সাদা রঙ এর আঠালো ফাদ ব্যবহার করুন। আক্রমণ বেশি হলে ইমিডাক্লোরোপ্রিড জাতীয় কীটনাশক যেমন- এডমায়ার অথবা টিডো ৭-১০ মিলিলিটার / ২ মুঠ। ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে প্রতি ৫ শতকে স্প্রে করতে হবে ১০ দিন পরপর ২/৩ বার।
- ফলের মাছি পোকা- সাইপারমেথ্রিন জাতীয় কীটনাশক যেমন- ওস্তাদ ২০ মিলিলিটার অথবা ম্যাজিক অথবা কট ১০ মিলিলিটার প্রতি ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে প্রতি ৫ শতকে স্প্রে করতে হবে ১০- ১২ দিন পরপর ২/৩ বার।
আধুনিক করলা চাষ পদ্ধতিতে রোগবালাই :
- ডাউন মিলডিউ রোগ- ম্যানকোজেব জাতীয় ছত্রাকনাশক যেমন- রিডোমিল গোল্ড পানিতে ২০ গ্রাম মিশিয়ে ১০- ১২ দিনে ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে ।
- পাতা কোঁকড়ানো রোগ - জমিতে বাহক পোকা দমনের জন্য ইমিডাক্লোরোপ্রিড জাতীয় কীটনাশক যেমন- এডামায়ার অথবা টিডো ১০ মি.লি ২ মুখ। ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে প্রতি ৫ শতকে স্প্রে করতে হবে।
- মোজাইক ভাইরাস রোগ - জমিতে সাদা মাছি দেখা গেলে ইমিডাক্লোরোপ্রিড জাতীয় কীটনাশক যেমন- এডমায়ার অথবা টিডো ১০ মি.লি. ২ মুখ করে ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে প্রতি শতকে স্প্রে করতে হবে।
সর্তকতা: বালাইনাশক / কীটনাশক ব্যবহারের আগে বোতল বা প্যাকেটের গায়ের লেবেল ভালো করে পড়ে নিতে হবে এবং নির্দেশাবলি মেনে চলতে হবে। ব্যবহারের সময় নিরাপত্তা পোশাক পরিধান করতে হবে। বহারের সময় কোন ধরণের ধূনপান এবং পানাহার করা যাবে না। বালাইনাশক ছিটানো জমির পানি যাতে মুক্ত জলাশয়ে না মেশে তা লক্ষ্য রাখুন। বালাইনাশক প্রয়োগ করা জমির ফসল কমপক্ষে সাত থেকে পনের দিন পর বাজারজাত করুন। বালাইনাশক / কীটনাশক ব্যবহারের সময় নিরাপত্তা পোশাক পরিধানের না করলে আপনার জন্য সমস্যা হবে।
করলার বিভিন্ন জাতের বৈশিষ্ট্য :
- বারি করলা -১ : বারি করলা -১ জাতটি গাঢ় সবুজ রঙের ২৫-৩০ টি ফল ধরে একটি গাছে ।
- প্রতি ফলের গঢ় ওজন ১০০ গ্রাম যা লম্বায় ১৭-২০ সেমি এবং ব্যাস ৪-৫ সেমি।
এ জাতটি ছাড়াও স্থানীয় সহজলভ্য জাতের চাষ হচ্ছে তারমধ্যে টিয়া ও গজ করলা বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। আধুনিক পদ্ধতিতে করলা চাষের জন্য করলার সঠিক জাত নির্বাচন করা গুরুত্বপূর্ণ।
করলা চাষের উৎপাদন প্রযুক্তি :
জমি ও মাটির বর্ণনা : উষ্ণ ও আদ্র আবহাওয়ায় করলা ভাল জন্মে। পরিবেশগতভাবে এটি একটি কষ্টসহিষ্ণু উদ্ভিদ। মোটামুটি শুষ্ক আবহাওয়াতেও এটি জন্মানো যায়, তবে বৃষ্টিপাতের আধিক্য এর জন্য ক্ষতিকর। জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না। অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতে পরাগায়ন বিঘিতে হতে পারে। তাই শীতের দুই মাস বাদ দিলে বাংলাদেশে বছরের যে কোন সময় করলা জন্মনো যায়। শীতকালো গাছের বৃদ্ধির হার কমে আসে। ভালো ফলন পেতে হলে সারাদিন রোদ পায় এবং পর্যাপ্ত সেচের ব্যবসর্থা আছে এমন স্থানে করলা চাষ করা উচিত। সব রকম মাটিতেই করলার চাষ করা যেতে পারে, তবে জৈব সার সমৃদ্ধি দো -আশঁ ও বেলে আশঁ মাটিতে ভালো জন্মে। সারা বছর চাষ করা যায়। উচুঁ বেড তৈরি করে লবণাক্ত এলাকায় চাষ করা যায়।
করলা চাষের জন্য জমি তৈরি :
খরিফ মৌসুমে চাষ হয় বলে করলার জন্য এমন স্থান নির্বাচন করতে হবে যেখানে পানি জমার সম্ভবনা নেই। বসতবাড়িতে করলার চাষ করতে হলে দু' চারটি মাদায় বীজ বুনে গাছ বেয়ে উঠতে পারে এমন ব্যবস্থা করলেই হয়। তবে বাণিজ্যিক ভাবে চাষের জন্য প্রথমে সম্পূর্ণ জমি ৪-৫ বার চাষ ও মই দিয়ে প্রস্তত করে নিতে হবে যেন করলার শিকড় সহজেই ছড়িয়ে যেতে পারে। জমি বড় হলে নিদিষ্ট দূরত্বে নালা কেটে লম্বার কয়েক ভাগে ভাগ করে নিতে হয়। বেডের প্রশ্বস্ততা হবে ১.০ মিটার এবং দু' বেডের মাঝে ৩০ সেমি নালা থাকবে।
বিশেষ পরিচর্যা : লবনাক্ততা প্রশমনের জন্য চাষীর স্বাভাবিকের চেয়ে উঁচু বেড তৈরি করে এবং অনেক সময় মালচিং হিসেবে পলিথিত বা খড় ব্যবহার করে।
বীজের হার : করলা ও উচ্ছের জন্য হেক্টরপ্রতি যথাক্রমে ৬- ৭.৫ এবং ৩- ৩.৫ কেজি বীজের প্রয়োজন হয়।
রোপণ : বছরের যে কোন সময় করলার চাষ সম্ভব হলেও এদেশে প্রধানত খরিফ মৌসুমেই করলার চাষ হয়ে থাকে। ফেব্রুয়ারি থেকে মে মাসের মধ্যে যে কোন সময় করলার বীজ বোনা যেতে পারে। কেউ কেউ জানুয়ারি মাসেও বীজ বুনে থাকে কিন্তু এ সময় তাপমাত্রা কম থাকায় গাছ দ্রুত বাড়তে পারে না, ফলে আগাম ফসল উৎপাদনে তেমন সুবিধা হয় না। উচ্ছে কোন নির্দিষ্ট সময় নেই, বছরের যে কোন সময় এর চাষ করা যায়। তবে শীতকালে এটি বেশি চাষ হয়ে থাকে।
আধুনিক করলার চাষে মাছি পোকা :
স্ত্রী মাছি কচি ফলের নিচের দিকে ওভিপজিটর ঢুকিয়ে ডিম পাড়ে। ডিম পাড়ার স্থান থেকে পানির মত তরল পদার্থ বেড়িয়ে আসে যা শুকিয়ে বাদামি রঙ ধারন করে। ডিম থেকে ক্রিয়া বের হয়ে ফলের শসা খেতে শুরু করে এবং ফল হলুদ হয়ে পচে ঝড়ে যায়। দমণ ব্যবস্থাপনা -
- আক্রান্ত ফল বা ফুল সংগ্রহ করে নষ্ট করা বা পুড়ে ফেলা।
- বা জমি চাষ দিয়ে পোকার পুত্তলী পাখিদের খাবার সুযোগ করে দিন।
- ক্ষেতের মাঝে মাঝে কাঁঠালের মোথা দেয়া, এতে করলার পরিবর্তে স্ত্রী মাছি কাঁঠালের মোথায় ডিম পাড়বে এবং ক্ষতির পরিমাণ কম হবে।
- প্রথমে ফুল আসা মাত্র প্রতি ১০ শতাংশের জন্য রেফেরোমন ফাঁদ স্থাপন করা।
- আম বা খেজুরের রসে সামান্য বিষ মিশিয়ে তা বোতালে রেখে জানালা কেটে দিয়ে ক্ষেতের মাঝে মাঝে স্থাপন করা।
- পাকা মিষ্টি কুমড়া বা কুমড়া জাতীয় ফল ১০০গ্রাম কুচি করে কেটে তাতে সামান্য বিষ মিশিয়ে তা দিয়ে বিষটোপ তৈরি করে মাটির পাত্রে করে ক্ষেতের মাঝে মাঝে প্রতিস্থাপন করে রাখা ।
- সাইপারমেথ্রিন গ্রুপের কীটনাশক ১ মিলি হারে পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করা। স্প্রে করার পর ১৫ দিনের মধ্যে সেই সবজি খাওয়া বা বিক্রি করা যাবে না।
আধুনিক পদ্ধতিতে টবে করলা চাষ
- তিত করলা চাষের জন্য মাঝারি বা বড় টব কিংবা ড্রাম ব্যবহার করা যেতে পারে।
- হাফ ড্রামের তলার কিছু ছিদ্র করতে হবে যাতে অতিরিক্ত পানি নিষ্কাশিত হয়।
- হাফ ড্রামের তলার ছিদ্রগুলো ইদের ছোট ছোট টুকরা দিয়ে বন্ধ করে দিতে হবে।
- বীজ বোনার আগে পাত্রের মাটি ঝুরঝুরে করে নিতে হবে।
- করলা বা তিত করলার বীজ বোনার ২৪ ঘন্টা পূ্র্বে পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হবে।
- বীজ বোনার পর মাটি হাত দিয়ে সমান করে দিতে হবে এবং চেপে দিতে হবে।
- এই সবজি বীজ বোনার পর এতে নিয়মিন পানি দিতে হবে।
- তবে খেয়াল রাখতে হবে গাছের গোড়ায় যেন কখনই পানি জমে না থাকে।
- তাহলে গাছের গোড়া পচে যেতে পারে।
- তাই সঠিক নিয়মে পানি দিতে হবে।
- করলা চাষের ক্ষেত্রে সঠিকভাবে যত্ন নিতে হবে।
- গাছ একটু বড় হলে মাচা করে দিতে হবে।
- গাছে নিয়মিত কীটনাশক স্প্রে করতে হবে, লক্ষ্য রাখতে হবে এতে যেন কোন প্রকার পোকার আক্রমণ করতে না পারে।
- এছাড়া ছাদ সবসময় পরিষ্কার রাখতে হবে। তাহলে পোকামাকড়ের হাত থেকে রক্ষা আক্রমণ না হয়।
আমাদের মন্তব্য
আমারা আধুনিক পদ্ধতিতে করলা চাষের সম্পন্ন পদ্ধতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। করলা চাষের সঠিক সময়, কি পরিমাণ জমির জন্যে কতটুকু ফল পাবেন তার সকল বর্ণনা আমরা করেছি। আমাদের আলোচনা ছাড়া কোন প্রশ্ন থাকলে কমেন্টের মাধ্যমে আমাদের জানাতে পারেন। আমরা আমাদের সঠিক তথ্য দেওয়া চেষ্টা করব।
আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url